Skip to main content

কালীসাধক নজরুল ছিলেন শাক্তধর্মের অনুসারী হিন্দু : প্রমী

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত কবি। তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন শ্যামাসংগীত লিখে। তিনি হিন্দুদের ভালোবেসে শ্যামাসংগীত লিখেননি, তিনি শ্যামাসংগীত লিখিছিলেন শ্যামার প্রেমে অন্ধ হয়ে। মুসলমানদের মধ্যে নজরুলের বিরুদ্ধে  সবচেয়ে বড়ো অভিযোগের কারণ ছিল শ্যামাসংগীত রচনা। এক সময় পূর্ববঙ্গের বেতারেও নজরুলের শ্যামাসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মুসলিম হওয়ার কারণে হিন্দুদের একটা শ্রেণি নজরুলকে বিজাতি মনে করত। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের প্রতি অতি আগ্রহের জন্য একশ্রেণির মুসলমান নজরুলকে কাফের ঘোষণা করেছিল। কাফের ঘোষণা করায় ক্ষুব্ধ-নজরুল 'আমার কৈফিয়ৎ' কবিতায় লিখেছিলেন-
'‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!'’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতবর্ষ  ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতিতে উত্তাল। শক্তির প্রয়োগ তখন বিজয় অর্জন ও প্রাপ্তির অন্যতম উপায় হয়ে দাঁড়ায়।  সে সময় 'শাক্তদর্শন' নজরুলকে এত ব্যপকভাবে প্রভাবিত করে যে তিনি কালী সাধনা শুরু করেন এবং শাক্তধর্মে আনত হয়ে পড়েন। এসময় তিনি  ইসলামিক বিশ্বাসের উপর আস্থাহীন হয়ে অন্তরে শাক্তধর্মকে লালন করতে শুরু করেন। শাক্তধর্ম মানে শক্তিবাদ। এটি হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের অন্যতম। হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর– এ মতবাদের ওপর ভিত্তি করে শাক্তধর্মের উদ্ভব এবং  এ শাক্তদর্শন থেকে নজরুলের শ্যামাসংগীত রচনা শুরু।
শ্যামাবন্দনা বা শ্যামাদেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানকে শ্যামাসংগীত বলা হয়। দুর্গাদেবীর একটি বিশেষ রূপ ‘কালী’ এবং কালীদেবীর অন্য নাম শ্যামা। শ্যামা মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে নজরুল লিখেছেন-
“মার হাতে কালি মুখে কালি,
মা আমার কালিমাখা, মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি।
মোর লেখাপড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি।”
প্রবল আবেগের অতল গভীরতার কারণে নজরুলের শ্যামাসংগীত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। নজরুল কালীভক্ত ও শাক্তধর্মানুরাগী হওয়ায় হৃদয়ের গভীর থেকে শ্যামাসংগীতের মাধ্যমে শ্যামার প্রতি পরম ভক্তি নিবেদন করতে পেরেছিলেন। সে ভক্তি সাকার হয়েছিল তাঁর গানের ভাষায়। তিনি লিখেছেন-
“ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”
নজরুল প্রায় ৪০০০ গান রচনা করেছেন। যার এক বড়ো অংশই শ্যামা সঙ্গীত। সঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘রাঙাজবা’। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ১০০টি শ্যামা সঙ্গীত নিয়ে প্রকাশিত  গ্রন্থটিতে শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের ঐকান্তিক আকুলতা ও চরম আত্মসমর্পণ ‘রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত হয়। এটি যখন প্রকাশিত হয় নজরুল তখন কালী সাধনায় এতই মগ্ন  ছিলেন যে, কালী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতেন না। তখনই একদল  মুসলিম নজরুলকে কাফের ঘোষণা করে এবং অচিরে তাকে বোবা করে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করে।
নজরুলের কালীভক্তি কেবল তার শ্যামা সঙ্গীতে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তাঁর কবিতাতেও প্রকাশ পায়। ধূমকেতু কাব্যের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’  কবিতার জন্য নজরুলের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই কবিতাতেও ছিল শাক্তসাধনার বিহ্বল প্রকাশ। তিনি লিখেছেন :
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
অনেকে বলেন, নজরুল নাস্তিক ছিলেন,  না  তিনি  নাস্তিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন শাক্তক।  কোনো মুসলিম  কালী মায়ের পায়ে জবা দিয়ে মসজিদে যেতে পারেন না। আবার কোনো  নাস্তিক শ্যামাসংগীত যেমন রচনা করতে পারেন না তেমনি পারেন  পারেন না লিখতে নাতে রসুল। তিনি ছিলেন একজন সুবিধাভোগী সাম্প্রদায়িক।  তাঁর লেখা নাতে রসুল ও শ্যামাসংগীতের সংখ্যা এবং কবিতায় ইসলামের পরিবর্তে কালীর সীমাহীন প্রভাব দেখলে বোঝা যায় তিনি ছিলেন শাক্তধর্মের অনুসারী একজন হিন্দু এবং তিনি হিন্দু অবস্থায় মারা গেছেন।
এজন্য বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, নজরুলের  কবিতায় যে পরিমাণ উত্তেজনা ছিল সে পরিমাণ পুষ্টি…ছিল না…।

Comments

Popular posts from this blog

এ কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায় ~ দাউদ হায়দার

জন্ম আমার কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায় ভেসে এসেছি তোমাদের এই তিলোত্তমা শহরে কল্পিত ঈশ্বর আমার দোসর; পায়ে তার ঘুঙুর; হৃদয়ে মহৎ পূজো চুনকামে মুখবয়ব চিত্রিত; আ...

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না - নবারুণ ভট্টাচার্য

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে আমি তাকে ঘৃণা করি- যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না আমি তাকে ঘৃণা করি- আটজন মৃতদেহ চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে আমি চীৎকার করে উঠি আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময় আমি উন্মাদ হয়ে যাব আত্মহ্ত্যা করব যা ইচ্ছা চায় তাই করব। কবিতা এখনই লেখার সময় ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে এখনই কবিতা লেখা যায় তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয় স্থির দৃষ্টি রেখে এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায় ’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায় লক-আপের পাথর হিম কক্ষে ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে কবিতার প্রত...